ক্যাম্পাসের প্রমিথিউস ও সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য

রাজু ভাস্কর্য rajy vaskorjo
রাজু ও রাজু ভাস্কর্য I ছবি সংগৃহিত

 ক্যাম্পাসের প্রমিথিউস কে এই রাজু ?

রাজু। আদর-স্নেহ আর মমতা জড়ানো একটি নাম। যে নামটি, যে ছেলেটি আজও তাঁর মাকে কাঁদায়। সংগঠনের সাথীরাও সাথী হারানোর যন্ত্রণাকে বুকে ধারণ করে পথ চলছে সুন্দর আগামী নির্মাণে। রাজুও সুন্দর আগামী নির্মাণের সাহসী যোদ্ধা ছিলেন।

মঈন হোসেন রাজু’র জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৯ জুলাই। বরিশালের মেহেদীগঞ্জে। তবে রাজুর পরিবার প্রথমে চিটাগং ও পরে ঢাকাতে বসবাস শুরু করে। বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন। মা খাদিজা বেগম। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর প্রাইমারী ও হাইস্কুল। ১৯৮৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন রাজু। উঠেছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলে।

ছাত্র ইউনিয়ন ও রাজু

ঢাকাতে বসবাস করার সময়ে রাজু যুক্ত হন লড়াই-সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাথে। যুক্ত হয়ে প্রথমে শেরে বাংলা নগরে ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন। এরপর তেজগাঁও কলেজে গড়ে তোলেন ছাত্র ইউনিয়নের দূর্গ। ফলে তিনি তেজগাঁও থাকা কমিটির অন্যতম নেতা হয়ে ঊঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যুক্ত হন ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাথে। এ সময় তিনি ৯০’র স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ঢাবি ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত থাকার সময় প্রথমে তিনি শহীদুল্লাহ হল কমিটির সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সমাজকল্যাণ সম্পাদক এবং ওই বছর ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন (১৯৯১)।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জন্মলগ্ন থেকে নানা ধরনের শিক্ষাধিকার আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি “শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস বিরোধী” আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। যখনই কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে তখনই ছাত্র ইউনিয়ন তা প্রতিহত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। এমনই এক গৌরবের সময় ১৯৯২ সাল।

যেভাবে রাজু শহিদ হন

১৯৯২ সালের ১৩ই মার্চ দেশে স্বৈরতন্ত্রের অবসানের পর কেবল এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শুরু হয়ে গেছে তথাকথিত গণতান্ত্রিক দলগুলোর ক্ষমতা প্রদর্শন ও দখলদারিত্বের রাজনীতি। সেদিন সকালে ছাত্রদল কর্মী, মতান্তরে ছাত্রশিবির কর্মীকে পেটানোর মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাস উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এ ঘটনায় পুলিশের সাথে সাধারণ ছাত্রদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। দুপুরে সংঘর্ষ চলাকালীন কনুইয়ে ব্যথা অনুভব করেন মইন হোসেন রাজু। সে কারণে বাসায় ফিরে না গিয়ে হলের পথ ধরেন শহিদুল্লাহ হলের এই বাসিন্দা। হলের ১২২ নাম্বার রুমে রাজুর জন্য সিট বরাদ্দ ছিল। সেখানেই বিশ্রাম নিতে যান তিনি।

ছাত্র-পুলিশের সংঘর্ষের মাধ্যমে যে ঘটনা দুপুরেই শেষ হতে পারতো তা আর দুপুরে শেষ হয়নি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে না হতেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং বাংলাদেশ ছাত্রদলের নেতা কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে শুরু হয় গুলি বিনিময়। যেখানে শিক্ষার্থীরা আসে জ্ঞানচর্চার উদ্দেশ্যে, সেখানে চলতে থাকে তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম। ইতোমধ্যে এ খবর পৌঁছে যায় রাজুসহ ক্যাম্পাসের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কানে। তৎক্ষণাৎ শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ক্যাম্পাসে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য’ নামের একটি ব্যানার সামনে রেখে সন্ত্রাসবাদের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে। সে মিছিলে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা সন্ত্রাসবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। উত্তাল ক্যাম্পাসে সে সময় পর্যন্ত দু’পক্ষের রক্তক্ষয়ী বন্দুকযুদ্ধ চলছিল। মিছিলকারীদের সকলেই জানত যে, সন্ত্রাসীদের গুলি বর্ষণের কারণে যে কারুরই প্রাণহানি হতে পারে। তা জানা সত্ত্বেও মিছিলের অগ্রভাগে থেকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছিলেন মইন হোসেন রাজু। প্রিয় ক্যাম্পাস সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে না দেবার প্রত্যয়ে মৃত্যুকে ক্ষুদ্র করে দৃঢ় চিত্তে মিছিল সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। একদিকে চলছিল সন্ত্রাসের ত্রাস আর অন্যদিকে ছিল ত্রাসের বিরুদ্ধে বিমূর্ত প্রতিবাদ।

গুলি বিনিময়ের একপর্যায়ে অকস্মাৎ সন্ত্রাসীরা মিছিলটিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। ঘাতকের ছোঁড়া একটি বুলেট আচমকা রাজুর মস্তিস্ক ভেদ করে চলে যায়। গুলির আঘাতে রক্তসিক্ত হয়ে মাটিতে এলিয়ে পড়েন রাজু। দ্রুত পদে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের স্বপ্ন বুকে নিয়ে প্রাণের ক্যাম্পাসের মায়া ত্যাগ করে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন তিনি।

তার মৃত্যুতে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় আরও একবার নতুন করে জাগ্রত হয়। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় তৎকালীন ছাত্র-জনতা। রাজুর মৃত্যুতে নাগরিক কবি শামসুর রাহমান রচনা করেন তার অন্যতম বিখ্যাত কবিতা ‘পুরাণের পাখি’। তিনি তার কবিতার মাধ্যমে মইন হোসেন রাজুর এই আত্মত্যাগকে আরও মহিমান্বিত করেন। কবির ভাষায়-

রাজু, তুমি মেধার রশ্মি-ঝরানো চোখ মেলে তাকাও

তোমার জাগরণ আমাদের প্রাণের স্পন্দনের মতোই প্রয়োজন।

দিনদুপুরে মানুষ শিকারীরা খুব করেছে তোমাকে। 

টপকে-পড়া, ছিটকে-পড়া

তোমার রক্তের কণ্ঠস্বরে ছিল

পৈশাচিকতা হরণকারী গান। ঘাতক-নিয়ন্ত্রিত দেশে

হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলে তুমি,

মধ্যযুগের প্রেতনৃত্য স্তব্ধ করার শুভ শ্লোক

উচ্চারিত হয়েছিল তোমার কণ্ঠে,

তোমার হাতে ছিল নরপশুদের রুখে দাঁড়াবার

মানবতা-চিহ্নিত প্রগতির পতাকা

তাই ওরা, বর্বরতা আর অন্ধকারের প্রতিনিধিরা,

তোমাকে, আমাদের বিপন্ন বাগানের

সবচেয়ে সুন্দর সুরভিত ফুলগুলির একজনকে,

হনন করেছে, আমাদের ভবিষ্যতের বুকে

সেঁটে দিয়েছে চক্ষুবিহীন কোটরের মতো একটি দগদগে গর্ত।

রাজুর মৃত্যুর খবর যেভাবে পরিবার পায়

raju vaskorjo
ছবি: রতন দাস

২০১৯ সালের মার্চে এক স্মৃতিকথায় সেই ঘটনার বর্ণনা দেন রাজুর বড় ভাই মুনীম হোসেন রানা। এই পদার্থবিদ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।

স্মৃতিকথায় মুনীম উল্লেখ করেন, ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চের দিনটি ছিল শুক্রবার। তাঁদের বাবা আমেরিকা থেকে দেশে এসেছেন। পরিবারের সবাই মিলে ইফতার করার রেওয়াজ ছিল। রাজু ছাড়া তাঁরা সবাই ইফতার করছিলেন। এমন সময় বাসায় ফোন এল। খাবার টেবিল থেকে উঠে গিয়ে তিনি ফোনটা ধরলেন। অপর প্রান্তে আতঙ্কের সুর। বললেন, ‘রানা ভাই, হাসপাতালে আসেন।’ এইটুকু বলেই ফোনটা রেখে দেওয়া হয়। তখন মোবাইল ছিল না। ফিরতি কল করবেন, সেটাও সম্ভব হলো না। কিন্তু তাঁরা নিশ্চিত বুঝে ফেলেন, রাজুর কিছু একটা হয়েছে।

খবর শুনে বাসা থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়েন মুনীম। বেবিট্যাক্সিতে ওঠার সময় এক বন্ধুকে বলেন মা-বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে। শ্যামলী থেকে অল্প সময়েই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান তিনি। জরুরি বিভাগে গিয়ে অনেককে দেখতে পেলেন, যাঁদের অনেককেই তিনি রাজুর বন্ধু হিসেবে চিনতেন।

তখনো মুনীম জানতেন না, রাজু গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাই তাঁদের কাছে জানতে চান, ‘কী হয়েছে?’কিন্তু কেউ কিছু বলছিলেন না। সবাই শুধু সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, ‘চিন্তা করবেন না, রক্তের ব্যবস্থা করছি।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক ছিলেন মুনীমের বন্ধু। তাঁকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দুজনের রক্তের গ্রুপ এক, আমার রক্ত নিন।’

মুনীমের খালুও হাসপাতালে এসেছিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি এসে অস্ফুটে বলেন, ‘সম্ভবত ও (রাজু) আর নেই।’ তাঁর কথা শুনে মুনীমের পুরো পৃথিবী যেন থমকে দাঁড়ায়। তখন রাত নয়টা-দশটা। রাজুর মৃত্যুর খবর জানাজানি হয়ে গেছে।

হাসপাতালে এক কোণে থাকা রাজুর বাবা শোকে স্তব্ধ। এর মধ্যে পুলিশ তাঁকে ডেকে মৃতদেহ নেওয়ার নিয়মকানুন বলে। পরে নিয়ম মেনে রাজুকে নিয়ে যাওয়া হয়। মরদেহ দাফনের পর রাজুর গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার পূর্বাপর জানতে পারেন মুনীম।

যেভাবে তৈরি হলো সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এলাকার সড়কের ওপর সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষার্থীদের কাছে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে পরিচিত এই ভাস্কর্য।

raju vaskorjo students union
রাজু ভাস্কর্যের মডেলরা

শহীদ রাজুর স্মরণে ও সন্ত্রাসবিরোধী চেতনা  রাজু ভাস্কর্যের মডেলরা ধরে রাখার প্রত্যয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ও রাজুর বন্ধুদের উদ্যোগে টিএসসি এলাকার সড়কের ওপর নির্মাণ করা হয় সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য। এ ভাস্কর্যে আটজনের অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাঁরা হলেন মুনীম হোসেন রানা, শাহানা আক্তার শিলু, সাঈদ হাসান তুহিন, আবদুল্লাহ মাহমুদ খান, তাসফির সিদ্দিক, হাসান হাফিজুর রহমান সোহেল, উৎপল চন্দ্র রায় ও গোলাম কিবরিয়া রনি।ভাস্কর্যে রাজুর যে অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, মুনীম হোসেনকে সামনে রেখে সেটি তৈরি করেছিলেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী।

এই ভাস্কর্য নিমার্ণে জড়িত শিল্পীরা হলেন ভাস্বর শ্যামল চৌধুরী ও তার সহযোগী গোপাল পাল। নির্মাণ ও স্থাপনের অর্থায়নে ছিলেন - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আতাউদ্দিন খান (আতা খান) ও মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতির সভাপতি, লায়ন নজরুল ইসলাম খান বাদল। ভাস্কর্যটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।
ভাস্কর্যটি নির্মাণের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দিক থেকে কোনো আপত্তি ছিল না। তবে আপত্তি তুলেছিল ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।
১৯৯৬-৯৭ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা আসলাম খান এ ভাস্কর্য স্থাপনে যুক্ত ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে। আসলাম খান বলেছিলেন, তাঁরা প্রথমে টিএসসি এলাকার ডাসের পাশে যেখানে রাজু গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিলেন। পরে একটি বড় আকারের ভাস্কর্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এখন যেখানে ভাস্কর্যটি আছে, সেখানে স্থাপন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে গেলে তিনি ইতিবাচক মনোভাব দেখান। কিন্তু রাস্তাটি ঢাকা সিটি করপোরেশনের। সেখান থেকে আপত্তি তোলা হয়। তবে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ রাজু ভাস্কর্য স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিলেন বলে জানান আসলাম খান। তিনি বলেন, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়া এ কে আজাদ চৌধুরী এটি উদ্বোধন করেন। ভাস্কর্যটি উন্মোচন করেছিলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান।


তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো ও ছাত্র ইউনিয়ন

Post a Comment

0 Comments