বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ হলো বার্ষিক বাজেট, যা প্রতিটি নাগরিকের জীবনযাত্রাকে সরাসরি প্রভাবিত করে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিগত করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের জন্য বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও সাধারণ মানুষের জীবিকার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বাস্তবতায় করমুক্ত আয়সীমায় পরিবর্তনের ব্যাপারে সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা থাকলেও সরকার এবারে কোনো সংশোধন আনেনি।
এবার ব্যক্তিগত আয়কর খাতে “জুলাই যোদ্ধা” নামে নতুন একটি ক্যাটাগরি যুক্ত করা হয়েছে। গেজেটভুক্ত আহত জুলাই যোদ্ধাদের করমুক্ত আয়সীমা মুক্তিযোদ্ধাদের সমান। অর্থাৎ ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
বিশেষশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা:
তবে কিছু শ্রেণির নাগরিকদের জন্য
করমুক্ত আয়ের সীমা আগের মতোই কিছুটা বেশি রাখা হয়েছে:
শ্রেণি |
করমুক্ত আয়ের সর্বোচ্চ সীমা |
নারী
ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে নাগরিক |
৪
লাখ টাকা |
প্রতিবন্ধী
ব্যক্তি ও তৃতীয় লিঙ্গের নাগরিক |
৪
লাখ ৭৫ হাজার টাকা |
গেজেটভুক্ত
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা |
৫
লাখ টাকা |
‘২৪
এর গণ-আন্দোলনের “জুলাই যোদ্ধা” |
৫
লাখ ২৫ হাজার টাকা |
কর কাঠামোর সারসংক্ষেপ:
করমুক্ত আয়সীমা অতিক্রম করলে দেশের সব এলাকায় ন্যূনতম
আয়কর দিতে হবে ৫ হাজার টাকা। ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৩০%
হারে একটি কর স্তর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া স্তরেও পুনর্বিন্যাস করা
হয়েছে।
করমুক্ত আয়সীমার পরবর্তী ১ লাখ টাকা পর্যন্ত করহার ৫%, পরবর্তী ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ১০%, পরবর্তী ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত ১০%, পরবর্তী ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫%, পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫%, পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ২০%, পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ২০%, পরবর্তী ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ২৫%, পরবর্তী ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ২৫%, অবশিষ্ট টাকার ওপর ৩০% এবং অবশিষ্ট টাকার পর ৩০% হারে আয়কর প্রযোজ্য হবে।
নতুন বাজেট ও কিছু কথা:
অর্থনীতিবিদদের মতে, মূল্যস্ফীতির চাপ
বিবেচনায় সাধারণ করদাতাদের করমুক্ত সীমা বাড়ানো সময়ের দাবি ছিল। তবে আগামী দুই
অর্থবছরে এ সীমা বৃদ্ধি করার আভাস দিয়েছেন নীতি নির্ধারকেরা।
২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরে করমুক্ত
আয়ের সীমা ধাপে ধাপে বাড়িয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বর্তমানে শহরে বসবাস করে পরিবার
চালাতে যেখানে মাসে ৫০-৬০ হাজার টাকা খরচ হয়, সেখানে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩.৫ লাখ
রাখা বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না।
অন্যদিকে, অর্থনীতিবিদরা বলছেন,
করমুক্ত সীমা না বাড়ালেও কর কাঠামোর স্বচ্ছতা এবং কর সেবায় প্রযুক্তির ব্যবহার
বাড়ানো দরকার।
প্রথমবারের মতো করদাতা হওয়া নাগরিকদের
জন্য ন্যূনতম কর মাত্র ১,০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে বেশি মানুষ কর
ব্যবস্থার আওতায় আসতে উৎসাহিত হন।
কেন বাড়ানো উচিত করমুক্তআয়ের সীমা?
১. মূল্যস্ফীতির চাপ:
বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। খাদ্য, বাসস্থান,
চিকিৎসা ও শিক্ষাখাতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য বাড়তি আয়কর
একটি বড় চাপ। করমুক্ত সীমা বাড়ালে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কিছুটা বাড়বে।
২. আয়বৈষম্য হ্রাস:
করমুক্ত সীমা বাড়ানো হলে নিম্নআয়ের মানুষদের disposable income বাড়বে, যা
অর্থনীতিতে চাহিদা সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে।
৩. কর আদায়ে স্বচ্ছতা:
অনেক ক্ষেত্রে নিম্নআয়ের মানুষরাও কর ফাঁকি দিতে বাধ্য হন কারণ তাদের আয় করযোগ্য
সীমার কাছাকাছি। করমুক্ত সীমা বাড়ালে স্বতঃস্ফূর্ত করদাতার সংখ্যা বাড়তে পারে।
সম্ভাব্য প্রভাব:
· সরকারের রাজস্ব আয়: করমুক্ত সীমা
বাড়লে সরকারের কর রাজস্ব কিছুটা কমতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে করদাতার সংখ্যা বাড়লে
তা পুষিয়ে যেতে পারে।
·
ভোক্তা ব্যয় বৃদ্ধি: সাধারণ মানুষের
হাতে বেশি টাকা থাকলে তা বাজারে ব্যয় হবে, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
·
সামাজিক সুরক্ষা: নিম্নআয়ের
পরিবারগুলো স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় সেবায় বেশি বিনিয়োগ করতে পারবেন।
শেষ কথা
২০২৫-২৬ সালের
বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হলে তা সাধারণ মানুষের জন্য একটি ইতিবাচক সংবাদ হবে।
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে কর
ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও সামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় গ্রহণযোগ্য পরিবর্তন আনার ওপর
গুরুত্বারোপ করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে, শুধু
করমুক্ত সীমাই নয়, করের স্ল্যাবগুলোও যুক্তিসঙ্গতভাবে পুনর্বিন্যাস করা উচিত, যাতে
মধ্যবিত্তরাও বাড়তি করচাপে না পড়েন। সরকারের উচিত হবে ন্যায্য ও সমতাভিত্তিক
করনীতি প্রণয়ন করা, যা অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে।
0 Comments