বাংলাদেশে সত্যিকার
অর্থে ত্যাগ আর বিপ্লবের আদর্শ নিয়ে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন যারা, তাদের
মধ্যে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ অন্যতম ব্যক্তি। বাংলাদেশে বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে
তিনি ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা।
জন্ম, শিক্ষা ও ছাত্রজীবন
মোহাম্মদ ফরহাদ ১৯৩৮ সালের ৫ জুলাই জন্মেছিলেন তৎকালীন রংপুর জেলার বোদা উপজেলায় (বর্তমানে পঞ্চগড়)। একটি শিক্ষিত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে তিনি ছোটবেলা থেকেই সমাজের প্রতি সচেতন, ন্যায়বোধসম্পন্ন এবং সংগ্রামী মানসিকতার বিকাশ ঘটান। তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন কলকাতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবনে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও যুক্তিবাদী চিন্তাধারার অধিকারী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যুক্ত হন প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে। তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন -এর একজন সক্রিয় সংগঠক ছিলেন।
রাজনৈতিক
জীবন
পাকিস্তান
আমল:
১৯৬০-৭০
দশকে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হয়ে ওঠেন। যুক্ত হন পূর্ব
পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-এর সঙ্গে। ১৯৬২ সালে আইয়ূব
বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ এবং এখান থেকে সূচিত হয়
জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর প্রতিষ্ঠা। এই আন্দোলনের ফলে মোহাম্মদ ফরহাদের ওপর গ্রেফতারি
পরোয়ানা জারি হয়। ফলে গ্রেফতার এড়িয়ে গোপনে তাঁকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়।
১৯৬৬ সালে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সংগঠক নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন
ভূমিকা:
১৯৭১
সালে মোহাম্মদ ফরহাদ সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেন। তিনি কলকাতায়
রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত ও সহায়তা সংগঠিত করেন। একাত্তরে
ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ গেরিলা
বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার ছিলেন তিনি।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে:
স্বাধীনতার
পর বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত
পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে মোহাম্মদ ফরহাদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে
সিপিবি শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র আন্দোলনে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ
কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের (বাকশাল) কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। প্রজ্ঞাবান এ রাজনীতিবিদ ১৯৭৫
এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন
জেনারেল জিয়া ও পরবর্তী
সময়ে সামরিক শাসক এরশাদ শাসনামলে
গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
১৯৭৮
সালে জেনারেল এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ১৫ দল ও ৭ দলের যুগপৎ কর্মসূচি প্রণয়ন
ও আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মোহাম্মদ ফরহাদের ছিল বিশেষ ভূমিকা। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে
১৫ দলীয় প্রার্থী হিসেবে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সংসদে তিনি ছিলেন গরিব মানুষের কণ্ঠস্বর—শ্রমিক অধিকার, কৃষকের জমি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম রূপকারও ছিলেন
মোহাম্মদ
ফরহাদ বিশ্বাস করতেন যে “সত্যিকারের গণতন্ত্র কেবল নির্বাচন দিয়ে হয় না, এর জন্য দরকার
সমাজের ভিতরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য।”
তিনি
ছিলেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদে বিশ্বাসী। তবে তার চিন্তায় কঠোর ডগমার পরিবর্তে ছিল বাস্তবতার
মিশ্রণ।
তার রাজনৈতিক
দর্শনের মূল উপাদানগুলো:
·
শ্রমিক-কৃষক
ভিত্তিক সমাজ গঠন:
তিনি মনে করতেন,
পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়। তাই সমাজতন্ত্র কায়েম
করেই প্রকৃত গণতন্ত্র ও সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
·
ধর্মনিরপেক্ষতা
ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতা:
ধর্মকে ব্যক্তিগত
বিশ্বাসে সীমাবদ্ধ রেখে রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ রাখতে তিনি সোচ্চার ছিলেন।
·
গণতান্ত্রিক
বাম ঐক্য:
বিশ্বব্যাপী
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে চীন সোভিয়েত বিরোধের ফলে যে বিভেদ দেখা দেয় তার প্রভাবে এ
দেশের বাম আন্দোলনও পরস্পর বিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং ১৯৬৫ সালে ছাত্র গণসংগঠনেও
বিভক্তি দেখা দেয়। মোহাম্মদ ফরহাদ মস্কোপন্থী হিসেবে পরিচিত গোষ্ঠীর তরুণ নেতা হিসেবে
অধিষ্ঠিত হন। বামপন্থী দলগুলোর পারস্পরিক বিভেদে তিনি দুঃখ প্রকাশ করতেন। তাঁর মতে,
প্রকৃত পরিবর্তনের জন্য প্রগতিশীল শক্তির মধ্যে ঐক্য আবশ্যক।
দল গঠন ও সাংগঠনিক
কৌশল:
সিপিবির পুনর্গঠন:
১৯৭১-এর পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সিপিবিকে নতুনভাবে গড়ে তোলেন। বাম সংগঠনগুলোকে সংহত
করার চেষ্টা করেন—যেমন ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক ফেডারেশন, কৃষক সমিতি ইত্যাদি। গ্রামীণ
এলাকায় বাম রাজনীতি বিস্তারে কাজ করেন, যা তার নির্বাচনী জয়ে সাহায্য করে।
গণতান্ত্রিক
আন্দোলনে অংশগ্রহণ:
১৯৮০-এর দশকে
সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সক্রিয়। আওয়ামী লীগ, বাসদ, জাসদ, ও অন্যান্য
গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে ঐক্যমঞ্চ গঠনের উদ্যোগ নেন। সংসদে থেকেও তিনি সরকারবিরোধী যুক্তিনির্ভর
শক্তিশালী বিরোধী কণ্ঠ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
লেখক, চিন্তাবিদ
ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক
মোহাম্মদ
ফরহাদ ছিলেন একজন বামপন্থী লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তার রচনায় পাওয়া যায়— শ্রেণিসংগ্রাম
ও শোষণবিরোধী চেতনার তীব্র প্রকাশ, সমাজতন্ত্রের পক্ষে বাস্তবভিত্তিক যুক্তি, বাম ঐক্যের
প্রয়োজনীয়তা ও রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কারের আহ্বান। তিনি নিয়মিতভাবে লেখালেখি করতেন বিভিন্ন
প্রগতিশীল পত্রিকা ও সাময়িকীতে। মোহাম্মদ ফরহাদ স্বনামের চাইতে বেনামিতেই বেশিরভাগ
রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখেছেন। তাঁর একমাত্র প্রকাশিত গ্রন্থ উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থান।
মৃত্যু ও
প্রভাব
তৎকালীন
সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে বর্তমান রাশিয়ার মস্কোতে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ১৯৮৭
সালের ৯ অক্টোবর তিনি
মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে তৎকালীন রাজনৈতিক মহলে গভীর শোক ও আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
অনেকেই মনে করেন, তাঁর মৃত্যু একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফলও হতে পারে।
মোহাম্মদ ফরহাদের আদর্শকে ধরে রাখতে গঠিত হয় "ফরহাদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট"। এই ট্রাস্ট প্রতিবছর প্রগতিশীল কর্মী ও চিন্তাবিদদের সম্মাননা দেয়। প্রতি বছর ৫ জুন দিনটি “ফরহাদ দিবস” হিসেবে পালন করা হয়। এই দিনে সিপিবি, ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যান্য বাম সংগঠন আলোচনা, স্মরণসভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
শেষ কথা:
মোহাম্মদ
ফরহাদ ছিলেন এক আদর্শবাদী রাজনীতিক, একজন তাত্ত্বিক, সংগঠক এবং সংগ্রামী মানবতাবাদী।
তার রাজনীতি ছিল শ্রেণি-সচেতন, মূল্যবোধনির্ভর এবং গণমানুষের পাশে দাঁড়ানোর অবিচল সংকল্পে
গড়া। যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন শোষণমুক্ত সমাজ গঠনে। তিনি প্রমাণ করেছেন, রাজনীতি
মানে ক্ষমতার লোভ নয়, জনগণের পক্ষে সত্য বলার সাহস।
0 Comments